প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষুঃ
জাতিকে একটি স্বাধীন ভূখন্ড আর শোষণ-নিপীড়ন মুক্ত জীবন উপহার দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন যিনি তাঁকেই কিনা সবথেকে বড় ত্যাগটাই স্বীকার করতে হলো। নিজের পাশাপাশি সবংশ নির্মূল করা হলো, বংশলতিকাসহ কয়েক প্রজন্ম বিনাশ করা হলো। যুগে যুগে পৃথিবীর দেশে দেশে স্বাধীনতার এমন স্বপ্ন আরো অনেকে দেখেছিলেন। স্বপ্ন বাস্তবায়নে কেউ কেউ সফল হয়েছিলেন, আবার কেউ কেউ ব্যর্থও হয়েছেন। কিন্তু এতো বড় ত্যাগ স্বীকার পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এক ঘটনাও বটে।

যতবার জাতির জনককে জানার চেষ্টা করেছি ততবার আহত হয়েছি। এই বর্ণাঢ্য আত্মজীবনী যতবার পড়িনা কেন কখনো ক্লান্তি আসে না, তৃপ্তি মিটে না। যার হাত ধরে এদেশের স্বাধীনতা এলো, পরাধীন জাতির স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় এলো, শত্রুপক্ষও যাকে মারার মতো দুঃসাহস করতে পারেনি, তাকেই প্রাণ দিতে হলো স্বাধীন দেশে, সজাতির হাতেই। বীরত্বপূর্ণ এই জাতিকে এই একটি ঘটনার কলংক বয়ে বেড়াতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এই পাপের কোনো ক্ষমা নেই। এই কলংক মূছে যাবার নয়।

৭৫’ পরবর্তী এদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়াটাও অপরাধ ছিলো! ভাবা যায়! কি দুঃসময় পেছনে ফেলে এসেছে আজকের বাংলাদেশ!

আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের আরেক নিঠুর বাস্তবতা হলো, স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছরেও স্বাধীন বাংলার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান আজও সবার হতে পারলেন না, হতে পারলেন না সার্বজনীন। অথচ তিনি সবার জন্যই এই সুমহান ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। দল-গোষ্ঠীর বৃত্ত থেকে বের করে এনে দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশ আজও তাঁকে সবার শেখ মুজিব করতে পারেনি। এই এক বড়ই নিদারুণ বিড়ম্বনা।

একটা বিশেষ রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে জাতির পিতাকে স্মরণ করা হবে, সম্মানের আসনে রাখা হবে, জাতীয় শোক দিবস পালিত হবে, সকল সরকারি, আধা-সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে জাতির পিতার ছবি শোভাবর্ধন করবে। আর যদি ক্ষমতার হাত বদল হয় তাহলে বাস্তবতার এই চিত্র ভিন্ন হবে। কেন? এমন হওয়ার তো কথা নয়! সবার দায় থাকবে না কেন? আজকে উনার কন্যা আছেন। পরবর্তীতে নাতি-নাতনী আসবেন। সবমিলে আগামী হয়তো একশো বছর? তারপর কি হবে? তারপর কি বাংলার স্থপতি হারিয়ে যাবেন? যতদিন স্বাধীন এই বাংলাদেশ থাকবে ততদিন শেখ মুজিব সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনেই থাকবেন। এই নিশ্চয়তা কোথায় পাওয়া যাবে? এর একটাই মাত্র উপায় হতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রজন্মের কাছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং এই আয়োজন করতে হবে এখন থেকেই যদিও অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। আজকের এই বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের বৃহত্তর একটা অংশ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচয়হীন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা আর জ্ঞান বিহীন, দেশপ্রেমহীন। এটাই বাস্তবতা। এমন প্রজন্ম দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের অস্থিত্ব টিকে থাকবে কি? এই দেশের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা প্রতিটি তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কেন জানবে না! তারা কেন জানবে না- এই দেশ কি করে আমাদের হলো, বাংলা কি করে আমাদের মাতৃভাষা তথা রাষ্ট্রভাষা হলো। শেখ মুজিবুর রহমান কেন ‘বঙ্গবন্ধু’? কেন ‘জাতির জনক’? কেন জানবে না তারা?

প্রজন্ম যদি কেবল মুজিবীয় বেশভূষা গায়ে তুলে আত্মতুষ্টি পায় আর মুজিবীয় আদর্শকে ধারণ করতে না শেখে তাহলে জাতির পিতা কোন প্রজন্মের মাঝে বেঁচে থাকবেন?

তিনি এমনি একজন যিনি এদেশে বসবাসরত ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল নাগরিকের কাছ থেকে স্ব স্ব ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসারে তাঁর পারলৌকিক সদগতি কামনায় পুণ্য/সোয়াব হয় এমন ভাল কাজের ফল পাওয়ার যোগ্য। সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তাঁর জন্য প্রার্থনা-আরাধনা করা যায়। কারণিআমরা যত কিছুই বলি না কেন সব থেকে বড় সত্য এটাই যে সবার আগে দেশ বড়। একটা স্বাধীন দেশ যাদের নেই তারা ধর্মকর্ম, একটি সুন্দর জীবনযাপন কিছুই আশা করতে পারে না। ৭১ এর আগে যেমনি পারেনি এই পূর্ব বাংলার জনগণ।